নতুন বছরের ক্যালেন্ডার উল্টানোর আগে একটু ভাবুন

শায়খ আহমাদুল্লাহ


এক.


একটি বছর অতিবাহিত হওয়া মানে মূল্যবান জীবনের একটি অংশ খসে পড়া। কবরমুখী যাত্রার এই টার্নিং পয়েন্টে এসে আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে থাকা কোনো বুদ্ধিমান মানুষের কাজ হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি স্টপেজে দাঁড়িয়ে একজন বুদ্ধিমান লোক নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব করবে— এটাই স্বাভাবিক।


উমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা হিসাব গ্রহণ করার পূর্বেই নিজের হিসাব নিজেই নিয়ে রাখ।’ (যুহদ, আহমদ বিন হাম্বল-৬৩৩) সূরা হাশরে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, তাই আল্লাহও তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন।’ (সূরা হাশর, আয়াত ১৯)


সুনান তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে— ‘সেই (প্রকৃত) বুদ্ধিমান, যে নিজেই নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং পরকালের জন্য কাজ করে।’ (তিরমিযী, ২৪৫৯) সূরা মুমিনূনে আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগত বান্দাদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের প্রতিপালকের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে ….তারা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করে এবং তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সূরা মুমিনূন: ৫৭,৬১)


নতুন বছর এলেই কি আনন্দ-ফূর্তি করতে হবে? সব নতুনত্বে উৎসব আর উম্মাদনা উম্মাদেরই কাজ হতে পারে। একজন মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত আসামীর জন্য নতুন বছরের আগমন কখনোই ফুর্তির কারণ হতে পারে না। বরং প্রতিটি নতুন দিনই তার নিঃশ্বাসকে দীর্ঘায়িত করার কথা। আমরা সকলেই তো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতোই জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুর ঘোষণা মাথায় নিয়ে এসেছি। যে কোনো সময় সমন আসতে পারে! ইরশাদ হয়েছে— ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)


দুই.


নতুন বছরের প্রথম দিনকে উৎসবের মাধ্যমে উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ইরানের অগ্নিপুজকরা এর সূচনা করে। নতুন বছরের প্রথম দিনকে তারা ‘নওরোজ’ বলে থাকে। নওরোজ অর্থ নতুন দিন। এদিনে তারা উপাসনা ও উৎসবে মেতে ওঠে। হাজারো বছর ধরে এ সংস্কৃতি তারা পালন করে আসছে। গত কয়েক শতাব্দী পূর্বে খ্রিস্টানরাও খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপন করে আসছে।


বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন— ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের (অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের) নিয়ম-নীতির অন্ধ অনুকরণ করবে। এমনকি তারা কোনো গর্তে প্রবেশ করলে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে।’- (বুখারি:৩২৬৯ মুসলিম:২৬৬৯)


সুনান আবু দাঊদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন— ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বিবেচিত হবে।’-(আবু দাউদ:৪০৩১)


তিন.


ইংরেজি নববর্ষ বরণ উপলক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কোটি কোটি টাকা অপব্যয় করে আতশবাজি করা হয়। ফুর্তির নামে পশুদেরও হার মানানো নির্লজ্জতায় ডুবে যায় সমাজের বড় একটা অংশ। কথায় আছে, লজ্জা উঠে গেলে কোনো কিছু করতেই বাঁধ ও বাধা থাকে না। অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থা ও দারিদ্র্যর কশাঘাতে আহত সাধারণ জনগণকে যারা রক্ষা করার নসীহত করেন, ভদ্রতার ভেকধারী সমাজের সেসব লোক এবং রক্তচোষা বণিকেরা মেতে ওঠেন থার্টি ফার্স্ট নাইটের নগ্নতা ও উম্মাদনায়। নারীর অধিকার আদায়ের নামে ইসলামকে একহাত নেওয়া নারীবাদী সুশীলরা থার্টিফার্স্ট নাইটে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাংলা সংস্কৃতির ধ্বজাধারীরাও এ উপলক্ষে পশ্চিমা এই সংস্কৃতিতে ডুবে যান।


এদেশে কনকনে শীতে একটুখানি উষ্ণতার পরশ পাওয়ার মতো কাপড়ের অভাবে প্রতি বছর চরম কষ্টে নিপতিত হন বহু বনী আদম। অথচ প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট মাতাতে আসেন ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও কেনিয়ার ডিজেরা। রেডিসন, শেরাটন, রিজেন্সিতে পারফর্ম করেন তারা। তাদের নাচ ও গানের সঙ্গে থাকে এদেশীয় আইটেম গার্ল ও ডিজেদের নোংরামি। থাকে ফ্যাশন শো, আইটেম ড্যান্স ও লাইভ মিউজিক কনসার্ট।


চার.


আমরা মুখে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বললেও আদতে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের ক্রীড়নকে পরিণত। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসাযয়িক স্বার্থ-রক্ষার জন্য তারা আমাদের জন্য ডিজাইন করেন বিভিন্ন দিবস ও সংস্কৃতির।


প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার; এমনকি নিজ প্রবৃত্তির দাসত্বও ছাড়তে হবে আমাদেরকে। অন্যথায় আজীবন স্বাধীনতার খোলসেই পরাধীন হয়ে থাকবো আমরা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে শুদ্ধ চিন্তা ও সঠিক কাজ করার তাওফীক দান করুন। আমীন